দুর্গাপূজা বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া এমন এক উৎসব যা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক। যুগে যুগে দুর্গাপূজা তার রূপ ও ভাবের বিবর্তন ঘটিয়েছে, কিন্তু বাঙালির সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে।
সেকালের দুর্গাপূজা
সেকালের দুর্গাপূজা ছিল মূলত জমিদার বা অভিজাত পরিবারের আয়োজন। গ্রামাঞ্চলে পূজার সময় জমিদারবাড়িতে লোকসমাগম হতো, এবং সেই পুজোকে কেন্দ্র করে একাধিক অনুষ্ঠানও হতো। পূজার আয়োজনের পাশাপাশি নাটক, যাত্রা, কীর্তন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকত। স্থানীয় জনগণ এই পূজাকে তাঁদের নিজস্ব উৎসব হিসেবে দেখত। গণসামিলন এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা এতটাই মিশে ছিল যে, জমিদারদের পূজা আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি সামাজিক সম্মিলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠত।
তৎকালীন সময়ে দেবী দুর্গাকে মূলত একটি আদর্শ নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, যিনি দুষ্টকে দমন করে সৎ এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। পূজার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। পূজা পরিচালনার প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত কঠোর নিয়মের মধ্যে সম্পন্ন হতো।
একালের দুর্গাপূজা
বর্তমানে দুর্গাপূজা একটি আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক উৎসব হয়ে উঠেছে। কলকাতার মতো মহানগরী থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল, এমনকি বিদেশেও আজ দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একালের দুর্গাপূজার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো এর জনমুখী চরিত্র। এখন আর শুধুমাত্র জমিদারবাড়ি নয়, বরং স্থানীয় পাড়া বা বিভিন্ন ক্লাব কর্তৃক পুজোর আয়োজন করা হয়। এই পুজাগুলিকে সাধারণত বারোয়ারি পুজো বলা হয়। পাড়ার সদস্যরা মিলিতভাবে অর্থসংগ্রহ করে পুজোর আয়োজন করে, যা একটি বৃহত্তর সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
আধুনিক দুর্গাপূজায় থিম ভিত্তিক প্যান্ডেল, আলো এবং প্রতিমার চমকপ্রদ উপস্থাপনাই মূল আকর্ষণ। প্রতিমার সৃজনশীলতায় এখন সামাজিক বার্তা, সমসাময়িক বিষয়বস্তু উঠে আসে। দেবী দুর্গা এখন শুধুমাত্র অসুর বধকারী নন, বরং তিনি নারীশক্তি, নারীর অধিকার, প্রাকৃতিক সংরক্ষণ কিংবা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হিসেবেও উপস্থিত হন। এই পরিবর্তন বাঙালির চিন্তাভাবনার বিবর্তনের দিকটি স্পষ্ট করে তোলে।
সাংস্কৃতিক উদযাপন ও আধুনিকতা
সেকালের দুর্গাপূজার সাংস্কৃতিক উপাদান যেমন যাত্রা, কবিগান, কীর্তন, রামায়ণ-পাঠ এখন আধুনিক বিনোদন মাধ্যম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আজকের পূজায় সঙ্গীতানুষ্ঠান, ফ্যাশন শো, সিনেমা প্রদর্শনী এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। এতে পুজার ধর্মীয় দিক কিছুটা পেছনে চলে গেছে এবং বিনোদনের দিকটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
সমাজের ভূমিকা
সেকালের পুজা ছিল মূলত পরিবারের এবং সম্প্রদায়ের সমন্বিত আয়োজন। কিন্তু একালে, বিশেষ করে শহুরে অঞ্চলে, দুর্গাপূজা এক সামাজিক মেলবন্ধনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উৎসবের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের মানুষ একত্রিত হয়, সাময়িকভাবে হলেও শ্রেণি-বিভাজন ভুলে যায় এবং একসঙ্গে সময় কাটায়।
উপসংহার
একাল ও সেকালের দুর্গাপূজার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও মূল স্রোত একই। ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজের পরিবর্তন দুর্গাপূজার রূপকে বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন ভাবে উপস্থাপন করেছে। তবুও বাঙালির কাছে দুর্গাপূজা রয়ে গেছে এক চিরন্তন উৎসব, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে, এবং প্রতিনিয়ত নতুন রূপে নিজেদের আবিষ্কার করছে।