অমরপুর ছিল একটি ছোট্ট, শান্ত গ্রাম। প্রতিবছর দুর্গাপুজো ঘিরে গ্রামের মানুষদের মধ্যে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ত। পুজোর সময় গ্রামের প্রতিটি পরিবার মিলে মন্ডপ সাজাতো, আনন্দে মেতে উঠত সবাই। তবে এবারের পুজোয় ছিল একটু আলাদা উত্তেজনা। কারণ, অমরপুরের পুরনো রাজবাড়ির তালাবদ্ধ অংশটি বহু বছর ধরে অযত্নে পড়ে ছিল, আর গ্রামে কানাকানি ছিল—সেই বাড়িতে নাকি ভূতের বাস। গ্রামের মানুষরা কখনো সেদিকে পা বাড়াতো না।
মেঘলা, গ্রামের এক সাহসী কিশোরী, এসব ভূতের গল্পে বিশ্বাস করত না। সে বরাবরই কল্পনা আর যুক্তির মিশেলে চলতে পছন্দ করত। তবে পুজোয় সবসময় অন্যদের থেকে একটু আলাদা কিছু করার ইচ্ছে তার ছিল। সে ভাবল, এবারের পুজোয় যদি পুরনো রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে সবাইকে দেখানো যায় যে ভুত-প্রেত বলে কিছু নেই, তাহলে সে তার সাহস প্রমাণ করতে পারবে।
পুজোর দুদিন আগে, যখন সকলে প্রতিমার চোখে রঙ দিতে ব্যস্ত, মেঘলা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে এক জায়গায় বসে বলল, “আমি আজ রাতে রাজবাড়িতে যাবো। দেখে আসব, আসলেই সেখানে কোনো রহস্য আছে কিনা।”
বন্ধুরা প্রথমে তাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করল, “মেঘলা, কেউ ওখানে ঢুকে ফিরে আসেনি। শুনেছি, রাতে ওখানে অদ্ভুত আওয়াজ হয়। তুই কেন এই পাগলামি করতে যাচ্ছিস?”
কিন্তু মেঘলার দৃঢ় মনোভাব দেখে সবাই অবাক হল। ঠিক করল, কেউ যাবেনা, কিন্তু মেঘলার জন্য বাইরে অপেক্ষা করবে।
রাত গভীর হল। মেঘলা একাই হেঁটে চলল পুরনো রাজবাড়ির দিকে। বাড়ির গেট ধীরে ধীরে ঠেলে সে ঢুকল। ভিতরে ঢুকে সবকিছু অন্ধকার আর নীরব। বাতাসে একটা পুরনো ধুলোর গন্ধ। তার সারা শরীর ভয়ে শিরশির করছিল, কিন্তু সে সাহস হারাল না। একটা পুরনো কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু একটা ভেঙে পড়ার আওয়াজে চমকে উঠল মেঘলা। কিন্তু কিছুই হল না।
রাজবাড়ির সবচেয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে সে দেখতে পেল, সেখানকার এক কোণায় বহু পুরনো মূর্তি ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে। মেঘলার চোখ আটকে গেল একটা মাটির প্রতিমার দিকে, যেটা খুবই পুরনো হলেও অদ্ভুতভাবে সুন্দর। সেই প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের সমস্ত ভয় চলে গেল।
কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে মেঘলা অনুভব করল, রাজবাড়িতে ভূতের গল্পগুলো শুধুই কল্পনা। আসলে পুরনো বাড়িগুলির ভাঙ্গাচোরা পরিবেশই মানুষের মনে এমন সব ভয় সৃষ্টি করে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, পুজোয় সবার সামনে গিয়ে জানাবে, এখানে কোনো ভয়ের কিছু নেই।
পরের দিন সকালে, পুজোর মন্ডপে সবাই যখন প্রতিমার সাজসজ্জায় ব্যস্ত, মেঘলা এসে হাজির হল। সে রাজবাড়ির গল্প সবাইকে খুলে বলল। গ্রামের মানুষ প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু মেঘলার সাহস দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। মেঘলা বলল, “আমাদের মধ্যে ভয়ের গল্পগুলো আসলে আমাদের কল্পনার ফসল। আমরা একসাথে থাকলে, সাহস থাকলে কোনো কিছুই আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না।”
সেই পুজোর পর থেকে অমরপুরের মানুষ আর ভূতের গল্পে বিশ্বাস করল না। তারা জানল, সাহস আর যুক্তি থাকলে জীবনের সব বাধা সহজেই পার করা যায়। মেঘলার সাহসিকতা সবাইকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল।