দুর্গা পূজা বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক মহা উৎসব। শরৎকালে দেবী দুর্গার আবির্ভাবের এই উৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির হৃদয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা একটি আবেগপ্রবণ সময়। দেবী দুর্গা, যিনি মহিষাসুরকে বধ করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি শক্তির প্রতীক এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয়ের প্রতিরূপ।
দুর্গা পূজার ইতিহাস
দুর্গা পূজার শুরু প্রায় চারশ বছর আগে জমিদারদের আমলে। যদিও তখন এটি ছিল মূলত পারিবারিক পূজা, ক্রমে তা সামাজিক পূজায় রূপান্তরিত হয়। আজকের দিনে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা বিশ্বের বাঙালিরা দুর্গা পূজাকে এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপন করে। প্রতিটি মণ্ডপে দেবী দুর্গার মূর্তি, তার চারটি সন্তান – লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ – এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পূজার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
পূজার প্রস্তুতি
দুর্গা পূজার প্রস্তুতি শুরু হয় মাসখানেক আগে থেকেই। মৃৎশিল্পীরা প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, আর মণ্ডপে মণ্ডপে থিম নিয়ে চলে নানা পরিকল্পনা। প্রতিমার গায়ে রঙ, তার সাজ, এবং মণ্ডপের অলঙ্করণ সবই থাকে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও সৃজনশীল। থিম পূজার প্রচলন সাম্প্রতিককালে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেখানে মণ্ডপগুলিকে বিশেষ কোনো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়।
মহালয়া: পূজার সূচনা
মহালয়ার দিনটি দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এই দিনে চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার পৃথিবীতে আগমন ঘোষণা করা হয়। “মহিষাসুরমর্দিনী” রেডিও সম্প্রচারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের শ্লোকগুলো মহালয়ার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
পূজার দিনগুলো
দুর্গা পূজা পাঁচদিনব্যাপী উদযাপিত হয় – ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত। ষষ্ঠীর দিন দেবী দুর্গার বোধন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে সন্ধিপুজো, এবং নবমীতে মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দশমীর দিনে দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়, যা বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। সেদিন সবাই একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে, মিষ্টিমুখ করে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
দুর্গা পূজা: এক সর্বজনীন উৎসব
যদিও দুর্গা পূজা হিন্দু ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু এটি আজকে বাঙালি জীবনের এক অংশ হয়ে গেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই উৎসবে শামিল হয়। ঠাকুর দেখা, আলোকসজ্জা, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা, এবং মেলা দুর্গা পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
উপসংহার
দুর্গা পূজা বাঙালির জন্য কেবল ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব নয়, এটি এক মিলনের মুহূর্ত। পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, নতুন পোশাক পরা, এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়া – এসব কিছুই দুর্গা পূজাকে এক অনন্য উৎসবে পরিণত করে।